গ্রন্থ পর্যালোচনা
সমীর রায়চৌধুরী :
'দীপঙ্কর দত্ত'র কবিতা' কাব্যগ্রন্থটি এ মুহুর্তে রয়েছে আলোচনার টেবিলে। তেতাল্লিশটি কবিতা বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে তুলে সংগ্রহ তৈরি করেছেন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছটি কাব্যগ্রন্থ - আগ্নেয় বসন্তের জাগলার, কাউন্টার ব্লো, ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস, পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা, নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা, জিরো আওয়ার পাওয়ার পোয়েট্রি।
এই গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন অজিত রায় ধানবাদ নিবাসী। "পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা''র ভূমিকা লিখেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। তাঁর "ব্রজঘাট" শীর্ষক কবিতায় তিনি প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরেছেন শ্রী বারীন ঘোষালের কথা।
পূণ্যিপুকুর ব্রত বাংলার নারীরা বহু বছর ধরে পালন করে আসছে। এটি স্ত্রী আচারের মধ্যে পড়ে। সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য এই ব্রত পালিত হয়। "ব্রজঘাট" কবিতায় পূণ্যিপুকুরের কথা এসেছে। আধুনিক দাম্পত্যজীবনের পটভূমিকায় তিনি এই প্রাচীন ব্রতটিকে রেখেছেন। সারবত্তা তুলে ধরতে চাইছেন বিরোধাভাসের মাধ্যমে। স্ত্রী আচরণের জন্য পূণ্যিপুকুরটি ছিল শিবপার্বতীর প্রেমরসায়নে জারিত। কবি পূণ্যিপুকুর সম্পর্কে বলেছেন - "জল ঢুকছে আখিরকার উডবি সারোগেট এই পূণ্যিপুকুরে"। দিল্লী প্রবাসী কবি "শেষমেষ" এই কথাটির পরিবর্তে "আখিরকার" এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি ছত্রেই আছে এরকম পরীক্ষানিরীক্ষা।
"জোহরাজবি" শব্দটি ব্যবহার করেছেন সুন্দরীতমা প্রেয়সীর খাতিরে কিন্তু হৃদয়ের দুটি জমজ ভেন্ট্রিকলকে জোহরাজবি অভিধায় চিহ্নিত করা - এ একমাত্র দীপঙ্কর দত্তের পক্ষেই সম্ভব। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে দিল্লীতে "জোহরাজবি" নামক একটি মূর্তি আছে, সেটি নারীর। সেটির আপাদমস্তক দর্শনে কামভাব জাগরিত হতে পারে, এমন কামভাব যে গাড়ীর চাকাও তার থেকে রেহাই পায় না। এবং শিরা উপশিরায় তা ছড়িয়ে পড়ছে স্ফীত হচ্ছে। যৌনতার এমন শিরশিরে বর্ণনা ! দুর্ধর্ষতায় তা শক্তিশালী ভাবে প্রকাশ করেছেন কবি। কবির কবিতায়ও এই শিল্পকর্মটির মতো মডার্ন ও প্রিমডার্ন শিল্পের সংমিশ্রণ ঘটেছে। 'জোহরা' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে শুকতারা, যে দিশা হারিয়ে ফেলেছে তাকে দিশার সন্ধান দেওয়া। এইভাবে কবিতাটিতে বহুকাজ রয়েছে যা গল্পের খেই ধরিয়ে দেবে পাঠককে। আমরা ছবির মতোই জীবনকে দেখতে দেখতে যাবো। কবিতাটি শেষ হয়েছে নবাব ব্রাহ্মণের উল্লেখে। 'ব্রাহ্মণ নবাব' কবি কমল চক্রবর্তীর একটি উপন্যাসের নাম। এই সব শব্দের মাধ্যমে কবি অপর কবিতার পরিসরকে ব্যাখ্যা করেছেন বা সীমানা বিস্তৃত করেছেন।
কবি দীপঙ্কর একসময় "স্থা-বিরোধী ম্যানিফেস্টো" প্রকাশ করেছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী দীপঙ্কর দত্তকে প্রশ্ন করেছিলেন ''how and where do you place yourself ?" উত্তরে দীপঙ্কর বলেছিলেন "কারুর পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তেল মারা, লাইন মারা, ধরণা দেওয়া, সুপারিশ অনুসারে নিজেকে দাখিল করা - আমার ধাতেই নেই। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ক্ষমতা অনুসারে সৎপথে যা উপার্জন করি, রুখা শুখা খাই, তাতেই খুশী। বস্তুতঃ আমার এই অলসতা, এক গুঁয়েমি, উচ্চাশাহীনতাই বলতে গেলে আমাকে 'আউটসাইডার' বা 'দি আদার' করেছে।" শর্মী পাণ্ডে এবং শুভঙ্কর দাশ পত্রিকার নাম প্রায়ই পাল্টে দেন। দীপঙ্কর শুভঙ্কর দাশের সঙ্গে একসময় দলবদ্ধ ছিলেন। "ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস" কবিতার বইটির নামকরণও জোরদার অভাবনীয়। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের গায়ে এই নির্দেশিকাটি লেখা থাকে। একটি লিফটের পাশে ঐ মেশিনটি দেখে তাৎক্ষণিক ভাবে তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হয় তা কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন। এমনিতেই তাঁর কবিতায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের প্রাবল্য আছে। তিনি এখানে সামান্য একটা ইভেন্ট থেকে স্পেসে চলে এসেছেন। কবিতাটির উদ্ধৃতি দিলাম :
ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস
ঘটনাটা এই যে আমি
যতবার বোঝাতে চেয়েছি যে আপৎকালে
ওসব মায়া-ফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো
ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়
ততবারই তাদের হো হো আর হি হি আর
আব্বে চুপ !
আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে
এখন যখন ঘরে আগুন লেগেছে আমি দেখিয়েছি
কাঁচের একেকটি বন্ধ খুপরীর ভেতরে অ্যালার্ম
লিফটের বোতাম, ট্যাপ আর ক্যাম্বিসের গোটানো মাইলটাক পাইপ
শাবলের পেছন দিকটা দিয়ে
ঠিস্
ঠিস্
ঠিন্ শব্দে ভাঙো
হ্যাঁচকা হিরহির পেতল নলের ওই হাঁয়ে বসাও
প্যাঁচ খোলো দ্যাখো জলস্রোত কামাল
তারা দেখছেনা তা নয় দেখছে কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে
কাঁচ বাক্সের ভেতরে যেই কে সেই শীতঘুম
বাস্পের মতো চুঁইয়ে বাইরে চোখগুলি বুঁদ হয়ে আসে
আগুন ছড়াতে থাকে
হাতের বাইরে চলে যায় আগুন —
দীপঙ্করের এটি খুব সহজবোধ্য কবিতা। তিনি পোস্টজেনেরিক বা কোনোরকম জেনার-এর মধ্যে যেতে চান না। জেনার ট্র্যাপড্ হবেন না বলেছেন। বলেছেন : "কবিতাকে ওপেন-এনডেড রাখার জন্য শুরুতে একটা প্রয়াস অবশ্যই ছিলো। এখন আর কোনো জবরদস্তি করি না। কবিতা যা হবার হয়ে ওঠে।"
এসব সাক্ষাৎকার অর্বাচীন ধুলো, ২০০০ সালে শর্মী পাণ্ডের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। আগেই বলেছি শর্মী-শুভঙ্কর কবিতা পত্রিকার নাম প্রায়ই পরিবর্তিত করতেন।
বারীন ঘোষাল ওনার সম্পর্কে বলেছেন -''শব্দের অসম্ভব ব্যবহার ; - কবি যখন প্রচলিত রীতি, ছন্দোপ্রকরণ এবং শব্দ শরব্যতায় শৃঙ্খলিত বা আন-ইজি বোধ করেন, তখনই নতুনের জন্য এই যাচনা জন্মায়, নতুন কবিতার জন্ম হয়।"
রেলরোড হাংগার
সিন নাইন্টিফাইভ শট সিক্সটিওয়ান টেক থ্রি ঠাক্। শুনিতে কি পাও পোস্টইন্ডাস্ট্রিয়াল পিনড্রপ অন দ্য রেট্রোকালচারাল ফ্লোর ? ফেসপ্যাকের সারপ্লাস মিক্স অব লাইভ অ্যান্ড লিপ-সিঙ্কড্ ভোকালস্ উড়ছে রাউটার পাথের খ্যাপলা তহেসনহেসে। ইউথ্ড্রন রিসীভার রাতভর যে টোন খেঁউড়ালো রিডায়াল রিপিট ডায়ালে, ভোর কবুল হলে নেকড়ের দখলী হাউল আর উইন্ডমেশিনের খোয়াইশপ্রাইস গলছে ডীপ ভি-নেক হল্টারের ডৌল থ্রাক্স লাচিতে। চোখে ঠুলি ছিল আগে বেতো ভাড়ে কা টাট্টুর। ফগফাড় রেল প্যারালাল ছুটতে ছুটতে রোডট্যাকল্সের অলগ থলগ জুদা কিন ও কিথেদের জোট এখন চাবিয়ে ফেলছে কুত্তি চীজ এই সাঁটা জিন স্টিরাপ লাগাম। হোলহুয়ীট টোস্ট শ্রেডেড চিকেনের তরে আজও মহীনেরা চরে। চেরা সাপজিভ লং ঘূর্ণি প্লেয়াচ্ছে ক্লিট কুঁড়ির ছিলকা নিওলিথ দুব্বো র্যাম্প লেবিয়াল উপছা খিলানে —
কবিতাটি শব্দ ধরে ধরে আলোচনার ধারা থেকে আলোচক বা পাঠককে বিরত রাখে। যে যেমন ইচ্ছে অর্থ করে নিতে পারেন। কবিতাটির পাঠ পরিসরের আদরাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন। শুধুমাত্র একটি ফ্রেমের ব্যাখ্যা। এভাবে অনেক ফ্রেম জুড়ে জুড়ে একটি ফিল্ম রচিত হয়। দীপঙ্করের কবিতায় শব্দ কোনো ফিক্সড্ ফ্রেম নয়। পাঠককে ফিক্সড্ ফ্রেমের অভ্যস্ত অবস্থান থেকে উৎখাত করা হয়। সমান্তরাল দুটি লাইনকে রেলের দ্রুতির বাহ্যিক গতি থেকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ঘোড়ার দৌড়কেও হার মানাচ্ছে। আজ জীবনের এই বাহ্যিক গতি দেখতে আমরা অভ্যস্ত। গতির খিদেকে হার মানাবে কে ? মানুষের লাগামহীন দৌড়কে ব্যঙ্গ করে এই অন্তর্লীন ভাবটাকে ছড়িয়ে দিয়ে তা ডায়াসপোরিক করে তুলেছেন। পাঠক শেষ অব্দি কী পাবে এটা তিনি ভাবেন না। অথচ একেকটি কবিতা বারবার পাঠ না করলে পাঠকের কণ্ডুয়নবৃত্তি থামতে পারবে না।
(কবিতা ক্যাম্পাস, কলকাতা বইমেলা, ২০১৪)
⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿
শব্দশাসনের দিললিপি
ধীমান চক্রবর্তী :
পুরানো কবিতার গতানুগতিকতা আর মোহজাল কাটিয়ে আশির দশকে যে একঝাঁক কবি অন্যধরণের কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন দীপঙ্কর দত্ত তাঁদের মধ্যে একজন। যুক্তির দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে, কবিতা কেন্দ্রকে সম্পূর্ণ তছনছ করে, তথাকথিত রোমান্টিকতাকে ভুলভুলাইয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে - আশির দশকের এই সব কবিদের প্রচেষ্টা নয় নয় করেও কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলার ম্যাদামারা জলহাওয়ার বাইরে, হিউমিডিটির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, লু-এর আননকো গরম বসন্তে দিল্লীবাসী এক কবি অন্যরকম লেখার চেষ্টা তো করবেনই। আর এখানেই অ্যাডভান্টেজ দীপঙ্করের। দেখা যাক অন্য মাত্রার এই স্বর কোথায় পৌঁছে দেয় পাঠককে -
কশে চাবুক মারো,
চিড় খাওয়া জল মুহুর্তে জুড়ে যায় ফের
শুধু কোপানো খোবলানো পিঠ পাছা ও পাঁজরগুলি
হাঁ হয়ে থাকে
ব্যাসিলাসময় রৌদ্রের সিরাম নোসোডগুলি
ছুঁয়ে যায় জায়মান বীজ — (ফ্লটস্যাম)
পিঁপরেরা থোক থোক মুখে ডিম
তোর ফাটলে সেঁধিয়ে যাবার প্রায় আঠেরো ঘণ্টা পর এই বৃষ্টি
যে ফেরার কার্তুজগুলি
রিভলবারের খোঁজে এসে দু'রাত হল্ট করে গেছে
তাদের সক্সের উৎকট বারুদ গন্ধের ব্যাপ্তি এই ফিল্ড (টোটা)
উপরের দুটি কবিতার মতই অন্যান্য বহু কবিতাতে, বা বলা যায় প্রায় সব কবিতাতেই একটি ছবি বা আংশিক ছবির সঙ্গে এক বা একাধিক টুকরো বিষয় বা ছবি জুড়ে দিয়ে, যুক্তির মুখে ঝামা ঘষে - ক্রমশ বিষয়হীনতার দিকে নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, ছবিশূন্যতার দিকে ক্রমশ হেঁটে যাওয়া বা দৌড়ানো দীপঙ্করের এক প্রিয় চলন। আধুনিকোত্তর কবিরা এই চেতনা আয়ত্ব করেছেন এবং কবিতায় প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং নীতি নিয়মের বাইরে পর্যবেক্ষণ করে তুলে আনছেন তাঁর অনুভব বা অনুভূতিমালা ; ফলে কবিতা ক্রমশ চলে যাচ্ছে চেতন থেকে সম্প্রসারিত চেতনায়। কবিতায় ফুটে উঠছে পোস্টমডার্ণ লক্ষণসমূহ। বইটি পড়লেই একথা জানা হয়ে যায় যে দীপঙ্করের পূর্বপ্রকাশিত ছ'টি কবিতার বই-এর মধ্যে দু'টির নাম এরকম ১) পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা, ২) নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা। সুতরাং পুরানো কবিতার ধ্যানধারণা, ইমেজ ছেড়ে যে তিনি বেরিয়ে আসবেন তাতে আর আশ্চর্য কী ! বাংলার বাইরে থাকার দরুণ তাঁর কবিতায় এক রুক্ষ কারুণ্যহীন অনুভূতি প্রান্তর লক্ষ্য করা যায়। কবিতায় অনূদিত হওয়া তাঁর পারিপার্শ্বিকতা আর দিনলিপি আমাদের এক বহুমাত্রিক জগতে নিয়ে যেতে চায়। যেমন -
১) কুয়াশার ডাবিং-এ ভোর ফাটছে
আর হাওয়ায় চাবুক উছলে উঠছে হিলহিলে রেল জ্যা
লেত্তির হ্যাঁচকা টানে লেলিয়ে দেওয়া ঘূর্ণি ট্রাম
এবার ছুটে আসছে আমার দিকে (কর্ড)
২) পাঁচ লাখ কিউসেক রক্তে ঢোল আমাদের যে ব্লটিং রুকস্যাকগুলির বয়া
উজানে খেদিয়ে নিয়ে যান শচীনদেব, চইচই ডাকের জবাবী ডেফনিং
শিস উঠছে বাতানুকূল ক্যায়দে বামুশক্কতে, বুদ্ধুভূতুমের ঢোলডগর,
নিপতনে সার্চলাইট ঝিমুচ্ছে নবাব ব্রাহ্মণের দেড়শ বিঘে ছৌ জাগীর
জিরেতে — (ব্রজঘাট)
দীপঙ্করের কবিতা এরকমই। শব্দ ব্যবহারে কোনো বাছবিচার নেই। যে কোনো শব্দ ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। তবে ইংরেজী শব্দের প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা নজরে পরে। এক-আধটা কবিতা পড়লে এরম মনে হওয়া দোষণীয় হবে না যে - বাংলা কবিতায় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার হয়েছে না ইংরেজী লেখায় বাংলা শব্দের এই ব্যবহার। কিন্তু তিনি যে এই সাহস দেখিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
(ইন্দ্রানী সাহিত্য, শারদীয়া ২০০৭)
⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿
আগ্নেয় বসন্তে একজন জাগলার
অনুপম মুখোপাধ্যায় :
দীপঙ্কর দত্ত একজন দিল্লি হাটার্স। অতএব আমরা তাঁর কাছে স্রেফ ব্যতিক্রম আশা করতে পারি। প্রত্যাশা করতে পারি একটি সচেতন মননের তাবৎ ক্ষুৎ-কাতরানি। আমরা ইতোপূর্বে তাঁকে আগ্নেয় বসন্তের জাগলার হিসেবে চিনে রেখেছিলাম। কবিতা তাঁর কাছে পেশা নয়, বৃত্তি নয়, খেতাব নয়, পুরস্কার নয়। কোনোরকম মনোপলিতে তিনি পা রাখবেন না। খুব কম কাগজেই তিনি লেখেন। প্রায় কোনো কাগজেই তাঁর লেখা চোখে পড়তে চায় না। আমি নিজে তাঁর লেখা দিল্লি হাটার্স, কবিতা ক্যাম্পাস, গ্রাফিত্তির বাইরে দেখিনি।
দীপঙ্কর দত্ত আশির দশকের কবি। এই দশক বাংলা কবিতায় কিছু করতে চেয়েছিল। এই দশকের প্রথম দিকেই এসেছিল স্বদেশ সেনের "রাখা হয়েছে কমলালেবু"। শব্দকে যেভাবে ব্যবহার করা যায় না, বাক্যকে যেভাবে বাঁকানো যায় না - সেটাই করলেন জামশেদপুরের এই কবি। তাঁর পেছনেই এসে পড়লেন কৌরবের বারীন ঘোষাল এবং হাওড়া-কলকাতার কবিতা ক্যাম্পাস গ্রুপ - অলোক বিশ্বাস, স্বপন রায়, ধীমান চক্রবর্তী, প্রণব পাল, রঞ্জন মৈত্র, জহর সেন মজুমদার, আর গ্রাফিত্তির শুভঙ্কর দাশ। এঁরা সকলেই দীপঙ্কর দত্তর সমধার্মিক, কিন্তু তফাৎ গড়ে দেয় দীপঙ্করের তুমুলতম স্ব-বিরোধীতা, কাচের দোকানে ষাঁড় হয়ে ওঠার ইচ্ছা। বাংলায় তিনিই হয়ত প্রথম 'পাওয়ার পোয়েট'। কবিতা তাঁর শখ নয়, মেরুদণ্ডে শক দেওয়ার হাতিয়ার। "ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস" কবিতায় তিনি সোজা বলেন -
ওসব মায়া-ফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো
ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়
সমীর রায়চৌধুরী :
'দীপঙ্কর দত্ত'র কবিতা' কাব্যগ্রন্থটি এ মুহুর্তে রয়েছে আলোচনার টেবিলে। তেতাল্লিশটি কবিতা বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে তুলে সংগ্রহ তৈরি করেছেন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছটি কাব্যগ্রন্থ - আগ্নেয় বসন্তের জাগলার, কাউন্টার ব্লো, ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস, পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা, নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা, জিরো আওয়ার পাওয়ার পোয়েট্রি।
এই গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন অজিত রায় ধানবাদ নিবাসী। "পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা''র ভূমিকা লিখেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। তাঁর "ব্রজঘাট" শীর্ষক কবিতায় তিনি প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরেছেন শ্রী বারীন ঘোষালের কথা।
পূণ্যিপুকুর ব্রত বাংলার নারীরা বহু বছর ধরে পালন করে আসছে। এটি স্ত্রী আচারের মধ্যে পড়ে। সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য এই ব্রত পালিত হয়। "ব্রজঘাট" কবিতায় পূণ্যিপুকুরের কথা এসেছে। আধুনিক দাম্পত্যজীবনের পটভূমিকায় তিনি এই প্রাচীন ব্রতটিকে রেখেছেন। সারবত্তা তুলে ধরতে চাইছেন বিরোধাভাসের মাধ্যমে। স্ত্রী আচরণের জন্য পূণ্যিপুকুরটি ছিল শিবপার্বতীর প্রেমরসায়নে জারিত। কবি পূণ্যিপুকুর সম্পর্কে বলেছেন - "জল ঢুকছে আখিরকার উডবি সারোগেট এই পূণ্যিপুকুরে"। দিল্লী প্রবাসী কবি "শেষমেষ" এই কথাটির পরিবর্তে "আখিরকার" এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি ছত্রেই আছে এরকম পরীক্ষানিরীক্ষা।
"জোহরাজবি" শব্দটি ব্যবহার করেছেন সুন্দরীতমা প্রেয়সীর খাতিরে কিন্তু হৃদয়ের দুটি জমজ ভেন্ট্রিকলকে জোহরাজবি অভিধায় চিহ্নিত করা - এ একমাত্র দীপঙ্কর দত্তের পক্ষেই সম্ভব। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে দিল্লীতে "জোহরাজবি" নামক একটি মূর্তি আছে, সেটি নারীর। সেটির আপাদমস্তক দর্শনে কামভাব জাগরিত হতে পারে, এমন কামভাব যে গাড়ীর চাকাও তার থেকে রেহাই পায় না। এবং শিরা উপশিরায় তা ছড়িয়ে পড়ছে স্ফীত হচ্ছে। যৌনতার এমন শিরশিরে বর্ণনা ! দুর্ধর্ষতায় তা শক্তিশালী ভাবে প্রকাশ করেছেন কবি। কবির কবিতায়ও এই শিল্পকর্মটির মতো মডার্ন ও প্রিমডার্ন শিল্পের সংমিশ্রণ ঘটেছে। 'জোহরা' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে শুকতারা, যে দিশা হারিয়ে ফেলেছে তাকে দিশার সন্ধান দেওয়া। এইভাবে কবিতাটিতে বহুকাজ রয়েছে যা গল্পের খেই ধরিয়ে দেবে পাঠককে। আমরা ছবির মতোই জীবনকে দেখতে দেখতে যাবো। কবিতাটি শেষ হয়েছে নবাব ব্রাহ্মণের উল্লেখে। 'ব্রাহ্মণ নবাব' কবি কমল চক্রবর্তীর একটি উপন্যাসের নাম। এই সব শব্দের মাধ্যমে কবি অপর কবিতার পরিসরকে ব্যাখ্যা করেছেন বা সীমানা বিস্তৃত করেছেন।
কবি দীপঙ্কর একসময় "স্থা-বিরোধী ম্যানিফেস্টো" প্রকাশ করেছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী দীপঙ্কর দত্তকে প্রশ্ন করেছিলেন ''how and where do you place yourself ?" উত্তরে দীপঙ্কর বলেছিলেন "কারুর পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তেল মারা, লাইন মারা, ধরণা দেওয়া, সুপারিশ অনুসারে নিজেকে দাখিল করা - আমার ধাতেই নেই। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ক্ষমতা অনুসারে সৎপথে যা উপার্জন করি, রুখা শুখা খাই, তাতেই খুশী। বস্তুতঃ আমার এই অলসতা, এক গুঁয়েমি, উচ্চাশাহীনতাই বলতে গেলে আমাকে 'আউটসাইডার' বা 'দি আদার' করেছে।" শর্মী পাণ্ডে এবং শুভঙ্কর দাশ পত্রিকার নাম প্রায়ই পাল্টে দেন। দীপঙ্কর শুভঙ্কর দাশের সঙ্গে একসময় দলবদ্ধ ছিলেন। "ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস" কবিতার বইটির নামকরণও জোরদার অভাবনীয়। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের গায়ে এই নির্দেশিকাটি লেখা থাকে। একটি লিফটের পাশে ঐ মেশিনটি দেখে তাৎক্ষণিক ভাবে তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হয় তা কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন। এমনিতেই তাঁর কবিতায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের প্রাবল্য আছে। তিনি এখানে সামান্য একটা ইভেন্ট থেকে স্পেসে চলে এসেছেন। কবিতাটির উদ্ধৃতি দিলাম :
ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস
ঘটনাটা এই যে আমি
যতবার বোঝাতে চেয়েছি যে আপৎকালে
ওসব মায়া-ফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো
ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়
ততবারই তাদের হো হো আর হি হি আর
আব্বে চুপ !
আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে
এখন যখন ঘরে আগুন লেগেছে আমি দেখিয়েছি
কাঁচের একেকটি বন্ধ খুপরীর ভেতরে অ্যালার্ম
লিফটের বোতাম, ট্যাপ আর ক্যাম্বিসের গোটানো মাইলটাক পাইপ
শাবলের পেছন দিকটা দিয়ে
ঠিস্
ঠিস্
ঠিন্ শব্দে ভাঙো
হ্যাঁচকা হিরহির পেতল নলের ওই হাঁয়ে বসাও
প্যাঁচ খোলো দ্যাখো জলস্রোত কামাল
তারা দেখছেনা তা নয় দেখছে কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে
কাঁচ বাক্সের ভেতরে যেই কে সেই শীতঘুম
বাস্পের মতো চুঁইয়ে বাইরে চোখগুলি বুঁদ হয়ে আসে
আগুন ছড়াতে থাকে
হাতের বাইরে চলে যায় আগুন —
দীপঙ্করের এটি খুব সহজবোধ্য কবিতা। তিনি পোস্টজেনেরিক বা কোনোরকম জেনার-এর মধ্যে যেতে চান না। জেনার ট্র্যাপড্ হবেন না বলেছেন। বলেছেন : "কবিতাকে ওপেন-এনডেড রাখার জন্য শুরুতে একটা প্রয়াস অবশ্যই ছিলো। এখন আর কোনো জবরদস্তি করি না। কবিতা যা হবার হয়ে ওঠে।"
এসব সাক্ষাৎকার অর্বাচীন ধুলো, ২০০০ সালে শর্মী পাণ্ডের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। আগেই বলেছি শর্মী-শুভঙ্কর কবিতা পত্রিকার নাম প্রায়ই পরিবর্তিত করতেন।
বারীন ঘোষাল ওনার সম্পর্কে বলেছেন -''শব্দের অসম্ভব ব্যবহার ; - কবি যখন প্রচলিত রীতি, ছন্দোপ্রকরণ এবং শব্দ শরব্যতায় শৃঙ্খলিত বা আন-ইজি বোধ করেন, তখনই নতুনের জন্য এই যাচনা জন্মায়, নতুন কবিতার জন্ম হয়।"
রেলরোড হাংগার
সিন নাইন্টিফাইভ শট সিক্সটিওয়ান টেক থ্রি ঠাক্। শুনিতে কি পাও পোস্টইন্ডাস্ট্রিয়াল পিনড্রপ অন দ্য রেট্রোকালচারাল ফ্লোর ? ফেসপ্যাকের সারপ্লাস মিক্স অব লাইভ অ্যান্ড লিপ-সিঙ্কড্ ভোকালস্ উড়ছে রাউটার পাথের খ্যাপলা তহেসনহেসে। ইউথ্ড্রন রিসীভার রাতভর যে টোন খেঁউড়ালো রিডায়াল রিপিট ডায়ালে, ভোর কবুল হলে নেকড়ের দখলী হাউল আর উইন্ডমেশিনের খোয়াইশপ্রাইস গলছে ডীপ ভি-নেক হল্টারের ডৌল থ্রাক্স লাচিতে। চোখে ঠুলি ছিল আগে বেতো ভাড়ে কা টাট্টুর। ফগফাড় রেল প্যারালাল ছুটতে ছুটতে রোডট্যাকল্সের অলগ থলগ জুদা কিন ও কিথেদের জোট এখন চাবিয়ে ফেলছে কুত্তি চীজ এই সাঁটা জিন স্টিরাপ লাগাম। হোলহুয়ীট টোস্ট শ্রেডেড চিকেনের তরে আজও মহীনেরা চরে। চেরা সাপজিভ লং ঘূর্ণি প্লেয়াচ্ছে ক্লিট কুঁড়ির ছিলকা নিওলিথ দুব্বো র্যাম্প লেবিয়াল উপছা খিলানে —
কবিতাটি শব্দ ধরে ধরে আলোচনার ধারা থেকে আলোচক বা পাঠককে বিরত রাখে। যে যেমন ইচ্ছে অর্থ করে নিতে পারেন। কবিতাটির পাঠ পরিসরের আদরাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন। শুধুমাত্র একটি ফ্রেমের ব্যাখ্যা। এভাবে অনেক ফ্রেম জুড়ে জুড়ে একটি ফিল্ম রচিত হয়। দীপঙ্করের কবিতায় শব্দ কোনো ফিক্সড্ ফ্রেম নয়। পাঠককে ফিক্সড্ ফ্রেমের অভ্যস্ত অবস্থান থেকে উৎখাত করা হয়। সমান্তরাল দুটি লাইনকে রেলের দ্রুতির বাহ্যিক গতি থেকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ঘোড়ার দৌড়কেও হার মানাচ্ছে। আজ জীবনের এই বাহ্যিক গতি দেখতে আমরা অভ্যস্ত। গতির খিদেকে হার মানাবে কে ? মানুষের লাগামহীন দৌড়কে ব্যঙ্গ করে এই অন্তর্লীন ভাবটাকে ছড়িয়ে দিয়ে তা ডায়াসপোরিক করে তুলেছেন। পাঠক শেষ অব্দি কী পাবে এটা তিনি ভাবেন না। অথচ একেকটি কবিতা বারবার পাঠ না করলে পাঠকের কণ্ডুয়নবৃত্তি থামতে পারবে না।
(কবিতা ক্যাম্পাস, কলকাতা বইমেলা, ২০১৪)
⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿
শব্দশাসনের দিললিপি
ধীমান চক্রবর্তী :
পুরানো কবিতার গতানুগতিকতা আর মোহজাল কাটিয়ে আশির দশকে যে একঝাঁক কবি অন্যধরণের কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন দীপঙ্কর দত্ত তাঁদের মধ্যে একজন। যুক্তির দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে, কবিতা কেন্দ্রকে সম্পূর্ণ তছনছ করে, তথাকথিত রোমান্টিকতাকে ভুলভুলাইয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে - আশির দশকের এই সব কবিদের প্রচেষ্টা নয় নয় করেও কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলার ম্যাদামারা জলহাওয়ার বাইরে, হিউমিডিটির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, লু-এর আননকো গরম বসন্তে দিল্লীবাসী এক কবি অন্যরকম লেখার চেষ্টা তো করবেনই। আর এখানেই অ্যাডভান্টেজ দীপঙ্করের। দেখা যাক অন্য মাত্রার এই স্বর কোথায় পৌঁছে দেয় পাঠককে -
কশে চাবুক মারো,
চিড় খাওয়া জল মুহুর্তে জুড়ে যায় ফের
শুধু কোপানো খোবলানো পিঠ পাছা ও পাঁজরগুলি
হাঁ হয়ে থাকে
ব্যাসিলাসময় রৌদ্রের সিরাম নোসোডগুলি
ছুঁয়ে যায় জায়মান বীজ — (ফ্লটস্যাম)
পিঁপরেরা থোক থোক মুখে ডিম
তোর ফাটলে সেঁধিয়ে যাবার প্রায় আঠেরো ঘণ্টা পর এই বৃষ্টি
যে ফেরার কার্তুজগুলি
রিভলবারের খোঁজে এসে দু'রাত হল্ট করে গেছে
তাদের সক্সের উৎকট বারুদ গন্ধের ব্যাপ্তি এই ফিল্ড (টোটা)
উপরের দুটি কবিতার মতই অন্যান্য বহু কবিতাতে, বা বলা যায় প্রায় সব কবিতাতেই একটি ছবি বা আংশিক ছবির সঙ্গে এক বা একাধিক টুকরো বিষয় বা ছবি জুড়ে দিয়ে, যুক্তির মুখে ঝামা ঘষে - ক্রমশ বিষয়হীনতার দিকে নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, ছবিশূন্যতার দিকে ক্রমশ হেঁটে যাওয়া বা দৌড়ানো দীপঙ্করের এক প্রিয় চলন। আধুনিকোত্তর কবিরা এই চেতনা আয়ত্ব করেছেন এবং কবিতায় প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং নীতি নিয়মের বাইরে পর্যবেক্ষণ করে তুলে আনছেন তাঁর অনুভব বা অনুভূতিমালা ; ফলে কবিতা ক্রমশ চলে যাচ্ছে চেতন থেকে সম্প্রসারিত চেতনায়। কবিতায় ফুটে উঠছে পোস্টমডার্ণ লক্ষণসমূহ। বইটি পড়লেই একথা জানা হয়ে যায় যে দীপঙ্করের পূর্বপ্রকাশিত ছ'টি কবিতার বই-এর মধ্যে দু'টির নাম এরকম ১) পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা, ২) নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা। সুতরাং পুরানো কবিতার ধ্যানধারণা, ইমেজ ছেড়ে যে তিনি বেরিয়ে আসবেন তাতে আর আশ্চর্য কী ! বাংলার বাইরে থাকার দরুণ তাঁর কবিতায় এক রুক্ষ কারুণ্যহীন অনুভূতি প্রান্তর লক্ষ্য করা যায়। কবিতায় অনূদিত হওয়া তাঁর পারিপার্শ্বিকতা আর দিনলিপি আমাদের এক বহুমাত্রিক জগতে নিয়ে যেতে চায়। যেমন -
১) কুয়াশার ডাবিং-এ ভোর ফাটছে
আর হাওয়ায় চাবুক উছলে উঠছে হিলহিলে রেল জ্যা
লেত্তির হ্যাঁচকা টানে লেলিয়ে দেওয়া ঘূর্ণি ট্রাম
এবার ছুটে আসছে আমার দিকে (কর্ড)
২) পাঁচ লাখ কিউসেক রক্তে ঢোল আমাদের যে ব্লটিং রুকস্যাকগুলির বয়া
উজানে খেদিয়ে নিয়ে যান শচীনদেব, চইচই ডাকের জবাবী ডেফনিং
শিস উঠছে বাতানুকূল ক্যায়দে বামুশক্কতে, বুদ্ধুভূতুমের ঢোলডগর,
নিপতনে সার্চলাইট ঝিমুচ্ছে নবাব ব্রাহ্মণের দেড়শ বিঘে ছৌ জাগীর
জিরেতে — (ব্রজঘাট)
দীপঙ্করের কবিতা এরকমই। শব্দ ব্যবহারে কোনো বাছবিচার নেই। যে কোনো শব্দ ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। তবে ইংরেজী শব্দের প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা নজরে পরে। এক-আধটা কবিতা পড়লে এরম মনে হওয়া দোষণীয় হবে না যে - বাংলা কবিতায় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার হয়েছে না ইংরেজী লেখায় বাংলা শব্দের এই ব্যবহার। কিন্তু তিনি যে এই সাহস দেখিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
(ইন্দ্রানী সাহিত্য, শারদীয়া ২০০৭)
⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿
আগ্নেয় বসন্তে একজন জাগলার
অনুপম মুখোপাধ্যায় :
দীপঙ্কর দত্ত একজন দিল্লি হাটার্স। অতএব আমরা তাঁর কাছে স্রেফ ব্যতিক্রম আশা করতে পারি। প্রত্যাশা করতে পারি একটি সচেতন মননের তাবৎ ক্ষুৎ-কাতরানি। আমরা ইতোপূর্বে তাঁকে আগ্নেয় বসন্তের জাগলার হিসেবে চিনে রেখেছিলাম। কবিতা তাঁর কাছে পেশা নয়, বৃত্তি নয়, খেতাব নয়, পুরস্কার নয়। কোনোরকম মনোপলিতে তিনি পা রাখবেন না। খুব কম কাগজেই তিনি লেখেন। প্রায় কোনো কাগজেই তাঁর লেখা চোখে পড়তে চায় না। আমি নিজে তাঁর লেখা দিল্লি হাটার্স, কবিতা ক্যাম্পাস, গ্রাফিত্তির বাইরে দেখিনি।
দীপঙ্কর দত্ত আশির দশকের কবি। এই দশক বাংলা কবিতায় কিছু করতে চেয়েছিল। এই দশকের প্রথম দিকেই এসেছিল স্বদেশ সেনের "রাখা হয়েছে কমলালেবু"। শব্দকে যেভাবে ব্যবহার করা যায় না, বাক্যকে যেভাবে বাঁকানো যায় না - সেটাই করলেন জামশেদপুরের এই কবি। তাঁর পেছনেই এসে পড়লেন কৌরবের বারীন ঘোষাল এবং হাওড়া-কলকাতার কবিতা ক্যাম্পাস গ্রুপ - অলোক বিশ্বাস, স্বপন রায়, ধীমান চক্রবর্তী, প্রণব পাল, রঞ্জন মৈত্র, জহর সেন মজুমদার, আর গ্রাফিত্তির শুভঙ্কর দাশ। এঁরা সকলেই দীপঙ্কর দত্তর সমধার্মিক, কিন্তু তফাৎ গড়ে দেয় দীপঙ্করের তুমুলতম স্ব-বিরোধীতা, কাচের দোকানে ষাঁড় হয়ে ওঠার ইচ্ছা। বাংলায় তিনিই হয়ত প্রথম 'পাওয়ার পোয়েট'। কবিতা তাঁর শখ নয়, মেরুদণ্ডে শক দেওয়ার হাতিয়ার। "ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস" কবিতায় তিনি সোজা বলেন -
ওসব মায়া-ফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো
ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়
যে ভাষায় কবিতায় তো বটেই, ভদ্রজনের মুখেও অপাংক্তেয়- তাই হয়েছে দীপঙ্কর দত্তর কাব্যভাষা। শব্দ ব্যবহারে তিনি যেন ষাটের হাংরি আন্দোলনের কাছে থেকে যান, হয়তো মলয় রায়চৌধুরীকে একটু পেরিয়ে গিয়েই। জীবনানন্দ বা শক্তির কবিতার পাঠক দীপঙ্কর দত্তর কবিতায় এলে ভির্মি খাবেন। আর দীপঙ্কর সেটাই চান। যেহেতু কবিতার বিনিময়ে তিনি কিস্যু চান না - অনায়াসে পেরেছেন শ্লীল এবং অশ্লীলের ভেদরেখাটিকে পুরোপুরিই মুছে ফেলতে। কিছু উদাহরণ তুলে আনছি -
১. ত্রিশ ত্রিশ ঠাপে বিড়ালমূতগন্ধী ঘামিয়ে উঠছি
২. ভ্যালিতে রোদ এলো রজঃদর্শন আর কি ফ্লো !
৩. কোন মাগী কেঁচকি নাছোড় ঠাপ নেয়
৪. খানকিচ্ছেলেদের চুলাচাক্কিতক পৌঁছনোর চোরা পথ
এ একান্তই তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা। "আগ্নেয় বসন্তের জাগলার" কবিতায় তিনি বলেনও -
অ্যাম সরি জানি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে,
কিন্তু স্যার উস্কানিটা আমি এভাবেই দেই এবং দেবো
অতএব তিনি সচেতন একশো শতাংশ। একে কেউ স্টান্ট বললে আমরা নিরুপায়। আমি একে শক থেরাপি বলব। ডায়াস্পোরিক টেক্সটের চূড়ান্ত উদাহরণ দীপঙ্করের কবিতা। দিল্লিতে প্রবাসী না হলে হয়তো দীপঙ্কর কবিতাই লিখতে পারতেন না। বাংলা কবিতার হ্যাঁ এবং না গুলোকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারতেন না। তাঁর কবিতার ভাসমান "আমি" আসলে একজন জন্মভূমিচ্যুত মানুষ। সে নিজের আত্ম-পরিচয় বিভিন্নভাবে খুঁজছে। আর দিল্লি প্রবাস দীপঙ্করকে দিয়েছে এইসব মোচর দেওয়া শব্দ -
রভি, ব্রাহমন, মা-ব্হ্যান, বোলবুলাবা, বিকাউ, সলতনৎ, দুসরা, ঝুগ্গী, জুরুয়া, আচারিয়া, বুলারহি হ্যায়
একটা সংস্কৃতি আরেকটা সংস্কৃতিতে অনিবার্য ঢুকে যাচ্ছে। একে আটকানো যায় না। আটকানোর চেষ্টা করাটাই বাতুলতা। অবশ্য যাঁরা এখনও বাংলা কবিতায় গুনে গুনে মাত্রা মেলান, পাঠককে আয়েস দেওয়ার জন্য লাইন ভাঙেন, মজা দেওয়ার জন্যে অন্ত্যমিল দেন - তাঁরা সেটা বুঝতে চাইবেন না। দেখেও দেখবেন না দুটো ভাষার প্রেম মৈথুন।
আলোচক হিসেবে আমি বলতে পারছি না দীপঙ্কর দত্ত আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও তুমুল প্রাসঙ্গিক থাকবেন। সে কথা বলার আমি কেউ নই। আমি স্রেফ বলব দীপঙ্কর দত্তর কবিতা বাংলা কবিতায় আজ প্রয়োজনীয়। কারণ হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে শক থেরাপি অনেক সময় খুব কাজে লেগে যায়। আর অমরত্ব খুবই আপেক্ষিক শব্দ। আজ যাঁরা বাজার কাঁপাচ্ছেন - বাজারের আড়ালে তাঁরাই সুন্দরভাবে মুছে যাচ্ছেন।
(অমৃতলোক ১১০, ২০০৭)
⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿
স্রোতের বিপরীত স্রোত : বিপজ্জনক কালখণ্ডের কবি দীপঙ্কর দত্ত
রবীন্দ্র গুহ :
রীতির বিপরীত রীতি ভাষাপ্রযুক্তির সৃজিত চমক তথা চালু প্যাটার্ন নয়। কুচুটে তথাকথিত বিকৃত নেবুলা ইউনিটারী ফ্যাতাড়ুদের ফাঁদ ডিঙোন মানেই রীতির বিপরীত অলটারনেটিভ অস্তিত্ব, সময় ও কালকেন্দ্রিক ঠাঁইবদলও নয়। অনিচ্ছাজনিত এলাকা হারানোর এই যে সাংস্কৃতিক কাউন্টার ডিসকোর্স, আধুনান্তিক কালখণ্ডে তার অন্যতম উদ্গম, মুক্তভাবনার ভৌগলিক পরিচয় পাওয়া যায় হাংরির ভাবকল্পে। তখনো ম্যল্-কালচার শুরু হয়নি, কিন্তু সুপার বাজার ও হাইওয়ে কালচার শুরু হয়ে গেছে। তুমিত্ব আমিত্বের পরিমণ্ডল বেড়েছে। কবিতার সিনট্যাক্স বদলাতে অন্তরাত্মায় নিদারুণ আসক্তি। আউটার বাংলার কিছু যুবামানুষ বাওয়ালি মেজাজে কবিতার আচার-বিচার বলনকেতা রীতির বিপরীত দোআঁশলা-রীতি নিয়ে বাংলাসাহিত্যের আদলবদল করতে এগিয়ে আসে। মদ্যেত-কুট বিদ্বৎজন হিন্দুসাহিত্যের চাটিবাটি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফলে, পরিস্থিতিটা খুবই কেয়টিক হয়ে ওঠে। মানবতন্ত্রের বিরোধিতা, কনফিউজিং ভাবনা, ভুল পদ্ধতির আধিপত্য।
আউটার বাংলার যুবকেরা প্রথমেই শব্দমুদ্রার বদলকরণ চাইল। দুধেভাতে থাকার প্রথা অগ্রাহ্য করল। যেকোন শব্দ ধ্বনির বাহক তাই কবিতা। চরিত্রবান বা অসৎচরিৎ বলে কোনো কথা নেই। এঁদের রচনা ক্লোজ এণ্ডেড নয়। চিন্তাক্রিয়া বহুস্তরীয়। দেশজ আখ্যান। অকুন্ঠিত প্রান্তিকতা। মানুষকে যা শেখানো যায় তাই শেখে, তবে অবশ্যই তার একটি নিজস্ব জগত থাকে। যা অনুকরণ নয়, বানানো নয়। এইরকম জীবনের কথাই বলার জন্য সহযাত্রীবন্ধুদের বোঝালো দীপঙ্কর। উগ্রতায়, অবৈধতায়, ঘৃণ্যতায়, বিষাদময়তায়, অসচেতনতায়, শূন্যতায় যে অ্যান্টিম্যাটার, যে অফুরন্ত অণুঘটনা, আকস্মিক আপতিক-প্রস্বর তা থেকেই আত্মার অসম্ভাব্যতা শুরু। হ্যাঁ প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য বা মৃত্যুই শেষ কথা নয়। বহুত্ব সর্বস্তরে সর্বব্যাপী অপগ্রস্ততার বিরুদ্ধে।
একটি নেগেটিভ মুহুর্তে "জিরো আওয়ারের" যাত্রা শুরু। হ্যাঁ, বলা উচিত লং-মার্চ শুরু। কর্ণধার দীপঙ্কর দত্ত। এক একটি কবিতা মানেই পরিত্রাহি ক্ষুরধ্বনি। নিস্কুন্ঠ বিদ্রোহ। স্ট্রেটফরোয়ার্ড সত্যের পাশাপাশি থাকত ক্যাপশন: "স্থা, স্থবিরত্বের প্রতীক। যাহা কিছু মৃত, মুমূর্ষু, বিকৃত, বিভ্রান্তিকর, তাহাই 'স্থা'। অথবা/ এবং 'Sleepless nights for Delhites.' অথবা/ এবং ''Central Bureau of investigation officials allegedly slapped and kicked a 13 years of school girl whose only fault was that she named the persons who had kidnapped her in February this year and gangraped her after keeping her in illegal custody for 45 days.''
অনুমান করা যায় 'জিরো আওয়ারের' কবি তিনজন মাত্র। তিন মস্ত জওয়ান। দিল্লির জান্তিজাদুকর গৌতম দাশগুপ্ত, অরূপ চৌধুরী, দীপঙ্কর দত্ত। মায়াবিভ্রম রাজধানী দিল্লিতে, কবিতায় প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করার মত অবস্থা। বহুস্বরিক জগৎ-জীবনের উত্তেজনার কথা, রীতিবদলের কথা, ভাষাচাতুর্যের কথা, দাপট দখলদারির কথা, জ্বলতা বিস্ময় ও দুঃখবিলাসের কথা, নিস্কপটতার কথা, অমিমাংসিত যন্ত্রণার কথা, ভয়ানক জেদের কথা, হীনতার কথা, অন্তরাত্মার বিরক্তির কথাই কবিতা। বিপথিক এবং ভ্রাম্যমান না হলে কবি হওয়া যায় না। জীবনের মধ্যে তলিয়ে যেতে হবে, সর্বহারা হতে হবে। বললো দীপঙ্কর দত্ত।
ইচ্ছা থেকেই ভালখারাপ। প্রতিটি মানুষের ইচ্ছায় স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। বললো গৌতম দাশগুপ্ত। শব্দ পুষে রাখার নয়, চলো, শব্দে ছত্রখান করে দিই জীবন।
অরূপ চৌধুরী বলল - কৃত্রিমতা নিয়ে ছুটছে যে মানুষ, তার মধ্যেই কবিতার স্বর্ণখনি। এখন আমি জেগে আছি, গেরিলার মত। কবিতার কোনো শর্ত নেই। কবিতা প্রভুর প্রভু ও ভ্যাঁড়ার ভ্যাঁড়া এবং ভ্যাঁড়ার প্রভু ও প্রভুর ভ্যাঁড়া -
দিল্লিতে কবিতার মৌরসিপাট্টা চালাচ্ছিলেন যারা, ধনীছন্দের বীরদর্পী লীলাখেলা করছিলেন তারা দ্রুত কবিতাবিহীন হয়ে গেলেন। সুতানুটি কলকাতা থেকে অনেকেই সন্ত্রাস প্রকাশ করলেন। অনেকে মুগ্ধ হয়ে লিখলেন - 'দিল্লির এ এক জবরদস্ত প্রজন্ম। মডার্নিস্টরা ভয় পেয়ে যাবেন।'
স্থিতাবস্থাকে ভাঙ্গতে 'জিরো আওয়ারের' উদ্যোগে বেরোল :
বনফায়ারের দিকে - গৌতম দাশগুপ্ত
জুরাসিক গিটার - অরূপ চৌধুরী
আগ্নেয় বসন্তের জাগলার - দীপঙ্কর দত্ত
নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা - দীপঙ্কর দত্ত
দিল্লির কবিতায় লু-বাতাস বয়ে গেল। পালিকা বাজারের চাঁদোয়ায় চিৎ হয়ে শুয়ে কবি দীপঙ্কর দত্ত 'ব্রেক টু গেন অ্যাকসেসের' কথা এইভাবে শোনাল - "ঘটনাটা এই যে আমি/ যতবার বোঝাতে চেয়েছি যে আপৎকালে/ ওসব মায়াফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো/ ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়/ ততবারই তাদের হো হো আর হি হি আর আব্বে চুপ ! / আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।"
কৈশোরবয়স থেকে রাজধানী দিল্লিতে থেকে বাঙালি সমাজের নীতিধর্মের তঞ্চকতার রদবদলের চমক দীপঙ্করকে মুহ্যমান করেনি, পৃথকও করেনি। খুব সহজভাবেই তা কাঠামোর মধ্যে কয়েদ করতে পেরেছে। তার কবিতার আয়রনিগুলো সুপার্ব। ভঙ্গিবিস্তারের দিকটি বিচার করলে দেখা যায় তার কবিতা শুধু দিল্লির নকলবাজ জনমানুষ তথা জলবায়ুর নাতাসম্পর্ক আর্থসামাজিক সাম্প্রদায়িকতা, শব্দের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই নয়, অস্তিত্বের অদ্ভুত ক্ষুধা নিয়ে সর্বত্র সে বর্তমান। রাজধানীতে গরিবি, মূল্যবৃদ্ধি, যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, শিশু শ্রমিক, হিউম্যান ট্রাফিকিং, ধর্ষণ, এসব নিয়ে 'জিরো আওয়ার'ই প্রথম বাউন্ডারি পেরিয়ে কথা বলে। এতদিন যে যাই বোঝাক, তা আদৌ জীবনের কথা নয়, সত্যের সারাৎসার নয়। কুড়া সাহিত্য। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা তো বটেই, বিশ্বায়ন লুটে নিয়েছে বীরভূম, বাঁকুড়া, গাজিয়াবাদ, লখনৌ, আজমের, গৌহাটি। এসব নিয়ে তাত্ত্বিকরা কেউ সক্রিয় নয়, নীতিভঙ্গের কথা বলে না। কম্পিউটার ঘরে এলে সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়, তারপর গেলাসে মদ। বৈদ্যুতিন খবরে, দৈনিকের পাতায় যে ভাষাশব্দ তা আদৌ কবিতায় আসা উচিত কিনা, খাঁটিত্বের আদেখলাপনা এবং অপর বৈপরিত্বের খাম্বাখুঁটি কতটা প্রকৃত শক্ত তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। সবাই ইউনিফর্ম পরিয়ে ভাষাকে মানানসই রাখতে উৎসাহী। সেখানে পরিস্থিতি ও পরিবেশ তুচ্ছ। স্থানিকতার চাপ, মুক্তমুখ ইশারা, জিদ পদ্ধতিকে ভাঙ্গতে সুযোগ পায় না। বহুত্বাকাঙ্খার দ্রোহজ্বালা ছিল দীপঙ্করের বুকে। পুরানো নক্সা ভেঙ্গে দিয়ে খেরুয়া শব্দে উড়নছু খেলা শুরু করল কবিতায়। এ কাজে সাফল্যের জন্য সে বস্তুবিশ্ব তথা কল্পনা জগত থেকে মানানসই বাচনশব্দ তুলে এনে পাঠবস্তুর ভিজিবিলিটি বাড়াল। জীর্ণ শব্দ, জাদুকরী শব্দ, অচ্ছুৎ শব্দ ঢুকে পড়ল দীপঙ্করের কবিতায়। শুধু বাচনভঙ্গী নয়, বানানও পাল্টে দিল। যেমন - রবি--> রভি, ব্রাহ্মণ --> ব্রাহমন, মা-বোন-->মা-ব্হ্যান, এবং বিকাউ, সলতনাৎ, সুৎরা কালো, বোলবুলাবা, কারতুৎ, সিলাবেল, হিফাজত, থোপা থোপা, পুঁছতে পুঁছতে। দীপঙ্করের ভাষার আশপাশ নানা দিক থেকে আরো অনেক ভাষা উঁকি মারে। বঙ্গভাষী বাবুমানস ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না। ভাষার খোলসবদল তাদের ব্যথা দেয়। অসত-কর্ম মনে হয়। অথচ ভাষার দোগলাপন (Hybridization) তো এখন সমস্ত বিশ্বজুড়ে। আমাদের পায়ের নিচে একাধিক পুঁজি এবং সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম। বিনিময়ের হাওয়া পরিবর্তনশীল। একটি পরিবারের চারজন সদস্য মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার প্রদেশের অধিবাসী। কারণ একজন ভ্রমণবিলাসী, একজন রিফিউজি, একজন অভিবাসনকামী, একজন রাজনৈতিক কারণে স্বভূমি থেকে নির্বাসিত। তাদের ঘিরে বিশ্ববাজার, বৈদ্যুতিন মিডিয়া, সংবাদপত্র, আন্তর্জাল। তাদের ঘিরে প্রতিমুহুর্তে বিভিন্নরকম অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণবাদের নতুন নতুন খেলা। ফলে, ছিৎরানো ভাব এসেই যাচ্ছে। এবং আইডেনটিটি ক্রাইসিস। ইতিহাস সাক্ষী, বদলাচ্ছে লেখ্যভাষা তথা কথ্যভাষা। ভাষা প্রযুক্তির কাঠামো বদলের এই নকশাটা দীপঙ্করের কলমে নিপুন ভাবে ফুটে ওঠে, যা সনাতন বাংলা ভাষাকে কাঁপিয়ে দেয়। এতে ভাষার আধিপত্য বাড়ছে অবশ্যই। নোনা-ধরা পাঁচিলগুলো এক-এক করে ধসে পড়ছে। বাংলা সাহিত্য নিজস্ব বোধবিন্যাসে আরো বাস্তবসম্মত হয়ে উঠছে। কর্তাব্যক্তিরা সীমানা ভেঙ্গে দিক বা না-দিক, একদিন এই দোসুতি ভাষাই সীমানা ভেঙ্গে দেবে। সাহিত্যিক শাসকদের বানানো অনুশাসনে বিভাজন থাকবে না। এবার দেখা যাক বহু জটিলতার মধ্যে কিভাবে বুদ্ধিবল দাগায়িত করেছে অধুনান্তিক কবি - তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ যার ভাষাকাঠামোয়, বাক্যসংগঠনে, শব্দে, শব্দার্থে জঁরের চৌহদ্দি ভেঙ্গেছে এবং ব্যাপক সঙ্করায়নের ছাপ তার নাম - 'আগ্নেয় বসন্তের জাগলার', দ্বিতীয় গ্রন্থ 'কাউন্টার ব্লো', তৃতীয় গ্রন্থ - 'ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস', চতুর্থ এবং সর্বাধুনিক গ্রন্থ - 'দীপঙ্কর দত্ত'র কবিতা'।
আগেই বলেছি, কবি বিশ্বাস করেন, কালখণ্ডের সাহিত্য সর্বজনীন। লেখার মধ্যে মরণপন প্রয়াস থাকবে, এবং বয়ানে নিরন্তর নতুনের উদযাপন। প্রান্তিকতাও একটি অনিবার্য সাংস্কৃতিক প্রতর্ক। দ্রোহ থাকবেই। অবক্ষয়, শূন্যতা, গ্লানি, হতাশার বিরুদ্ধে দ্রোহ। কবি পুঁজিবাদকে সবচেয়ে বহুবাচনিক পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আধুনিকোত্তরবাদ, তার মতে, এখন, এই সময়, পরিবর্তনের সন্ধিস্থল। দৌড়পুট দীপঙ্করকে বিশেষবৃত্তে আটকে রাখা যাচ্ছে না। সবদিকে ত্রুটি, মিথ্যাচার, দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতা। এইসবের মধ্যেই কবিতার মারাত্মক অর্থ খুঁজে বেড়ায় সে। চিন্তাচেতনায় লক্ষ লক্ষ স্ফুলিঙ্গ। তৈরী হয় আঙ্গিক ভেঙ্গে আঙ্গিকবিহীন আঙ্গিক সৃষ্টি। ''সরে দাঁড়া প্রায় দুশ ফুট এই উচ্চতা/ চুম্বকীয় আবেশ শেষ হয়ে গেলে/ পিস্টন আচমকা নেমে এসে থেঁতলে দিতে পারে/ হেই ওখানে ওখানে/ কলকব্জা লক্কর সব ওখানে ডাঁই হোক আর প্যাকিং বাক্সগুলো এদিকে'' (পোতাশ্রয়)। দীপঙ্কর নিজেই নিজের কর্তা। সর্বশেষ ভাঙ্গাগড়ার মালিক। একজন সৌখিন কৌশলী খেলোয়াড়। তার মতিগতি জীবনধারা ধরাবাঁধা গতিতে চলে না। হাত তোলার মাত্রা ভিন্ন। দৃষ্টি ভিন্ন। মগজে পাগলামির ধরণটিও ভিন্ন। তাই তার চেতনার আয়নাটিও ভিন্ন। ভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে শব্দের সঙ্গে খেলা। বিরোধিতা নয়, শুধু শব্দের কারেন্সি গোনা নয়, কবিতার শিরোনাম নির্বাচনেও দীপঙ্কর নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। যাতে অসাধারণ মজা আছে, থ্রিল আছে, ফরাৎনীল জাদুখেলা আছে। আরো আছে রুচি-পছন্দের খেরুয়া রসসম্পর্ক। যেমন, 'মিড সামার নাইটস হাউল', 'ব্রজঘাট', 'থান', 'দি ভার্টিক্যাল রেজ অব সান', 'দি সান অলসো রাইজেস', 'কোটাল', 'শাগির্দ', 'কর্ড', 'তছনছ ভীষণ কেয়সে', 'কাউন্টার ব্লো', 'আগ্নেয় বসন্তের জাগলার'। যখন নতুন কিছু সমাজ-সংসারে ঢুকে পড়ে, তখন খানিকটা বিবাদ, খানিকটা আদেখলাপনা থাকেই। দীপঙ্করের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে, বিবাদ যারা তুলছেন, তারা হাইব্রিডাইজেশন, নম্যাডিকতা, সাবঅল্টার্ন টেক্চুয়াল কি তা জানেন না। কবিতাকে একটি বিশেষ কাঠামোয় তুলে ধরা, চিত্রায়িত করা এবং আমিত্বের ঝোলাঝুলি নিয়ে কালজয়ী হওয়ার বাসনা নেই দীপঙ্করের, কিন্তু আমিত্ব-মনন-সচেতন, স্বজনপ্রিয়। অভিজ্ঞতায় অকৃত্রিম বৈভিন্ন আছে এইরকম কিছু কবি বন্ধুদের নিয়ে সে একটি জমজমা বসালো রাজধানীর দিল্লি হাটে। কে বলতে পারে, ঠিক এই জায়গাতেই মির্জা গালিব তাঁর ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে কবিতার আসর বসাতেন কি না। দিল্লি হাটের সংলগ্ন সফদরজং-চক্রউড়ালপুল। তার উত্তর দিক থেকে হাত দোলাতে দোলাতে মাথা দোলাতে দোলাতে আসে দিলীপ ফৌজদার, গৌতম দাশগুপ্ত, দেবব্রত সরকার। দক্ষিণের ব্রিজ পেরিয়ে আসে প্রাণজি বসাক, অরূপ চৌধুরী, কৃষ্ণা মিশ্রভট্টাচার্য। লম্বা আলখাল্লার মতো সফেদ কুর্তা পরে আসে সঞ্জীবন রায় টানেলের পথ ধরে। তখন দিল্লি হাটের পাথরের বেঞ্চগুলি তপ্ত খোলার মতো। দীপঙ্কর তারই ওপর পা তুলে বসে। নির্বিকার। বাওয়ালি মেজাজে নতুন ভাষায় কবিতা পাঠ শুরু হয়ে যায়। যুক্তিবিরোধী, প্রথাবিরোধী, তত্ত্ববিরোধী ''পাওয়ার পোয়েট্রি''। যা একান্তভাবেই দীপঙ্করের বাকবদ্ধ জীবনপাঠ। ভিত-কাঁপানো পৃষ্টধ্বনির তহবিল।
দিল্লির কবিদের দিশাবোধ থাক বা না থাক, বিলাসী দুঃখ তথা উদাসপারা আত্মজৈবনিক তারস আছে। গাণিতিক পণ্ডিতি-কালকেন্দ্রিকতা আছে। রীতির বিপরীত রীতি মুখজ্জাত ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে দীপঙ্কর এলো বায়ুপিত্ত কাঁপিয়ে। অতিকথন মিথ্যাকথন লঘুকথনের ক্যাননগুলি ভাঙতে শুরু করলো। এই যে সর্ববর্ণে বাঁকবদল, হৃদয়তাড়িত সর্বত্র অচ্ছুৎ আধমরা জৌলুসহীন খেরুয়া অকুলিন অবৈধ শব্দের তল্লাসী, ডিস্ট্রাকচারালাইজেশন, তা কি দীপঙ্করের রীতির বিপরীত প্রয়োগ রীতির জন্যই ?
(কবিতা ক্যাম্পাস, কলকাতা বইমেলা, ২০১১)
২. ভ্যালিতে রোদ এলো রজঃদর্শন আর কি ফ্লো !
৩. কোন মাগী কেঁচকি নাছোড় ঠাপ নেয়
৪. খানকিচ্ছেলেদের চুলাচাক্কিতক পৌঁছনোর চোরা পথ
এ একান্তই তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা। "আগ্নেয় বসন্তের জাগলার" কবিতায় তিনি বলেনও -
অ্যাম সরি জানি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে,
কিন্তু স্যার উস্কানিটা আমি এভাবেই দেই এবং দেবো
অতএব তিনি সচেতন একশো শতাংশ। একে কেউ স্টান্ট বললে আমরা নিরুপায়। আমি একে শক থেরাপি বলব। ডায়াস্পোরিক টেক্সটের চূড়ান্ত উদাহরণ দীপঙ্করের কবিতা। দিল্লিতে প্রবাসী না হলে হয়তো দীপঙ্কর কবিতাই লিখতে পারতেন না। বাংলা কবিতার হ্যাঁ এবং না গুলোকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারতেন না। তাঁর কবিতার ভাসমান "আমি" আসলে একজন জন্মভূমিচ্যুত মানুষ। সে নিজের আত্ম-পরিচয় বিভিন্নভাবে খুঁজছে। আর দিল্লি প্রবাস দীপঙ্করকে দিয়েছে এইসব মোচর দেওয়া শব্দ -
রভি, ব্রাহমন, মা-ব্হ্যান, বোলবুলাবা, বিকাউ, সলতনৎ, দুসরা, ঝুগ্গী, জুরুয়া, আচারিয়া, বুলারহি হ্যায়
একটা সংস্কৃতি আরেকটা সংস্কৃতিতে অনিবার্য ঢুকে যাচ্ছে। একে আটকানো যায় না। আটকানোর চেষ্টা করাটাই বাতুলতা। অবশ্য যাঁরা এখনও বাংলা কবিতায় গুনে গুনে মাত্রা মেলান, পাঠককে আয়েস দেওয়ার জন্য লাইন ভাঙেন, মজা দেওয়ার জন্যে অন্ত্যমিল দেন - তাঁরা সেটা বুঝতে চাইবেন না। দেখেও দেখবেন না দুটো ভাষার প্রেম মৈথুন।
আলোচক হিসেবে আমি বলতে পারছি না দীপঙ্কর দত্ত আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও তুমুল প্রাসঙ্গিক থাকবেন। সে কথা বলার আমি কেউ নই। আমি স্রেফ বলব দীপঙ্কর দত্তর কবিতা বাংলা কবিতায় আজ প্রয়োজনীয়। কারণ হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে শক থেরাপি অনেক সময় খুব কাজে লেগে যায়। আর অমরত্ব খুবই আপেক্ষিক শব্দ। আজ যাঁরা বাজার কাঁপাচ্ছেন - বাজারের আড়ালে তাঁরাই সুন্দরভাবে মুছে যাচ্ছেন।
(অমৃতলোক ১১০, ২০০৭)
⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿⠿
স্রোতের বিপরীত স্রোত : বিপজ্জনক কালখণ্ডের কবি দীপঙ্কর দত্ত
রবীন্দ্র গুহ :
রীতির বিপরীত রীতি ভাষাপ্রযুক্তির সৃজিত চমক তথা চালু প্যাটার্ন নয়। কুচুটে তথাকথিত বিকৃত নেবুলা ইউনিটারী ফ্যাতাড়ুদের ফাঁদ ডিঙোন মানেই রীতির বিপরীত অলটারনেটিভ অস্তিত্ব, সময় ও কালকেন্দ্রিক ঠাঁইবদলও নয়। অনিচ্ছাজনিত এলাকা হারানোর এই যে সাংস্কৃতিক কাউন্টার ডিসকোর্স, আধুনান্তিক কালখণ্ডে তার অন্যতম উদ্গম, মুক্তভাবনার ভৌগলিক পরিচয় পাওয়া যায় হাংরির ভাবকল্পে। তখনো ম্যল্-কালচার শুরু হয়নি, কিন্তু সুপার বাজার ও হাইওয়ে কালচার শুরু হয়ে গেছে। তুমিত্ব আমিত্বের পরিমণ্ডল বেড়েছে। কবিতার সিনট্যাক্স বদলাতে অন্তরাত্মায় নিদারুণ আসক্তি। আউটার বাংলার কিছু যুবামানুষ বাওয়ালি মেজাজে কবিতার আচার-বিচার বলনকেতা রীতির বিপরীত দোআঁশলা-রীতি নিয়ে বাংলাসাহিত্যের আদলবদল করতে এগিয়ে আসে। মদ্যেত-কুট বিদ্বৎজন হিন্দুসাহিত্যের চাটিবাটি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফলে, পরিস্থিতিটা খুবই কেয়টিক হয়ে ওঠে। মানবতন্ত্রের বিরোধিতা, কনফিউজিং ভাবনা, ভুল পদ্ধতির আধিপত্য।
আউটার বাংলার যুবকেরা প্রথমেই শব্দমুদ্রার বদলকরণ চাইল। দুধেভাতে থাকার প্রথা অগ্রাহ্য করল। যেকোন শব্দ ধ্বনির বাহক তাই কবিতা। চরিত্রবান বা অসৎচরিৎ বলে কোনো কথা নেই। এঁদের রচনা ক্লোজ এণ্ডেড নয়। চিন্তাক্রিয়া বহুস্তরীয়। দেশজ আখ্যান। অকুন্ঠিত প্রান্তিকতা। মানুষকে যা শেখানো যায় তাই শেখে, তবে অবশ্যই তার একটি নিজস্ব জগত থাকে। যা অনুকরণ নয়, বানানো নয়। এইরকম জীবনের কথাই বলার জন্য সহযাত্রীবন্ধুদের বোঝালো দীপঙ্কর। উগ্রতায়, অবৈধতায়, ঘৃণ্যতায়, বিষাদময়তায়, অসচেতনতায়, শূন্যতায় যে অ্যান্টিম্যাটার, যে অফুরন্ত অণুঘটনা, আকস্মিক আপতিক-প্রস্বর তা থেকেই আত্মার অসম্ভাব্যতা শুরু। হ্যাঁ প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য বা মৃত্যুই শেষ কথা নয়। বহুত্ব সর্বস্তরে সর্বব্যাপী অপগ্রস্ততার বিরুদ্ধে।
একটি নেগেটিভ মুহুর্তে "জিরো আওয়ারের" যাত্রা শুরু। হ্যাঁ, বলা উচিত লং-মার্চ শুরু। কর্ণধার দীপঙ্কর দত্ত। এক একটি কবিতা মানেই পরিত্রাহি ক্ষুরধ্বনি। নিস্কুন্ঠ বিদ্রোহ। স্ট্রেটফরোয়ার্ড সত্যের পাশাপাশি থাকত ক্যাপশন: "স্থা, স্থবিরত্বের প্রতীক। যাহা কিছু মৃত, মুমূর্ষু, বিকৃত, বিভ্রান্তিকর, তাহাই 'স্থা'। অথবা/ এবং 'Sleepless nights for Delhites.' অথবা/ এবং ''Central Bureau of investigation officials allegedly slapped and kicked a 13 years of school girl whose only fault was that she named the persons who had kidnapped her in February this year and gangraped her after keeping her in illegal custody for 45 days.''
অনুমান করা যায় 'জিরো আওয়ারের' কবি তিনজন মাত্র। তিন মস্ত জওয়ান। দিল্লির জান্তিজাদুকর গৌতম দাশগুপ্ত, অরূপ চৌধুরী, দীপঙ্কর দত্ত। মায়াবিভ্রম রাজধানী দিল্লিতে, কবিতায় প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করার মত অবস্থা। বহুস্বরিক জগৎ-জীবনের উত্তেজনার কথা, রীতিবদলের কথা, ভাষাচাতুর্যের কথা, দাপট দখলদারির কথা, জ্বলতা বিস্ময় ও দুঃখবিলাসের কথা, নিস্কপটতার কথা, অমিমাংসিত যন্ত্রণার কথা, ভয়ানক জেদের কথা, হীনতার কথা, অন্তরাত্মার বিরক্তির কথাই কবিতা। বিপথিক এবং ভ্রাম্যমান না হলে কবি হওয়া যায় না। জীবনের মধ্যে তলিয়ে যেতে হবে, সর্বহারা হতে হবে। বললো দীপঙ্কর দত্ত।
ইচ্ছা থেকেই ভালখারাপ। প্রতিটি মানুষের ইচ্ছায় স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। বললো গৌতম দাশগুপ্ত। শব্দ পুষে রাখার নয়, চলো, শব্দে ছত্রখান করে দিই জীবন।
অরূপ চৌধুরী বলল - কৃত্রিমতা নিয়ে ছুটছে যে মানুষ, তার মধ্যেই কবিতার স্বর্ণখনি। এখন আমি জেগে আছি, গেরিলার মত। কবিতার কোনো শর্ত নেই। কবিতা প্রভুর প্রভু ও ভ্যাঁড়ার ভ্যাঁড়া এবং ভ্যাঁড়ার প্রভু ও প্রভুর ভ্যাঁড়া -
দিল্লিতে কবিতার মৌরসিপাট্টা চালাচ্ছিলেন যারা, ধনীছন্দের বীরদর্পী লীলাখেলা করছিলেন তারা দ্রুত কবিতাবিহীন হয়ে গেলেন। সুতানুটি কলকাতা থেকে অনেকেই সন্ত্রাস প্রকাশ করলেন। অনেকে মুগ্ধ হয়ে লিখলেন - 'দিল্লির এ এক জবরদস্ত প্রজন্ম। মডার্নিস্টরা ভয় পেয়ে যাবেন।'
স্থিতাবস্থাকে ভাঙ্গতে 'জিরো আওয়ারের' উদ্যোগে বেরোল :
বনফায়ারের দিকে - গৌতম দাশগুপ্ত
জুরাসিক গিটার - অরূপ চৌধুরী
আগ্নেয় বসন্তের জাগলার - দীপঙ্কর দত্ত
নির্বাচিত পোস্টমডার্ন কবিতা - দীপঙ্কর দত্ত
দিল্লির কবিতায় লু-বাতাস বয়ে গেল। পালিকা বাজারের চাঁদোয়ায় চিৎ হয়ে শুয়ে কবি দীপঙ্কর দত্ত 'ব্রেক টু গেন অ্যাকসেসের' কথা এইভাবে শোনাল - "ঘটনাটা এই যে আমি/ যতবার বোঝাতে চেয়েছি যে আপৎকালে/ ওসব মায়াফায়া দ্বিধা ঢ্যামনামো/ ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়/ ততবারই তাদের হো হো আর হি হি আর আব্বে চুপ ! / আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।"
কৈশোরবয়স থেকে রাজধানী দিল্লিতে থেকে বাঙালি সমাজের নীতিধর্মের তঞ্চকতার রদবদলের চমক দীপঙ্করকে মুহ্যমান করেনি, পৃথকও করেনি। খুব সহজভাবেই তা কাঠামোর মধ্যে কয়েদ করতে পেরেছে। তার কবিতার আয়রনিগুলো সুপার্ব। ভঙ্গিবিস্তারের দিকটি বিচার করলে দেখা যায় তার কবিতা শুধু দিল্লির নকলবাজ জনমানুষ তথা জলবায়ুর নাতাসম্পর্ক আর্থসামাজিক সাম্প্রদায়িকতা, শব্দের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই নয়, অস্তিত্বের অদ্ভুত ক্ষুধা নিয়ে সর্বত্র সে বর্তমান। রাজধানীতে গরিবি, মূল্যবৃদ্ধি, যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, শিশু শ্রমিক, হিউম্যান ট্রাফিকিং, ধর্ষণ, এসব নিয়ে 'জিরো আওয়ার'ই প্রথম বাউন্ডারি পেরিয়ে কথা বলে। এতদিন যে যাই বোঝাক, তা আদৌ জীবনের কথা নয়, সত্যের সারাৎসার নয়। কুড়া সাহিত্য। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা তো বটেই, বিশ্বায়ন লুটে নিয়েছে বীরভূম, বাঁকুড়া, গাজিয়াবাদ, লখনৌ, আজমের, গৌহাটি। এসব নিয়ে তাত্ত্বিকরা কেউ সক্রিয় নয়, নীতিভঙ্গের কথা বলে না। কম্পিউটার ঘরে এলে সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়, তারপর গেলাসে মদ। বৈদ্যুতিন খবরে, দৈনিকের পাতায় যে ভাষাশব্দ তা আদৌ কবিতায় আসা উচিত কিনা, খাঁটিত্বের আদেখলাপনা এবং অপর বৈপরিত্বের খাম্বাখুঁটি কতটা প্রকৃত শক্ত তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। সবাই ইউনিফর্ম পরিয়ে ভাষাকে মানানসই রাখতে উৎসাহী। সেখানে পরিস্থিতি ও পরিবেশ তুচ্ছ। স্থানিকতার চাপ, মুক্তমুখ ইশারা, জিদ পদ্ধতিকে ভাঙ্গতে সুযোগ পায় না। বহুত্বাকাঙ্খার দ্রোহজ্বালা ছিল দীপঙ্করের বুকে। পুরানো নক্সা ভেঙ্গে দিয়ে খেরুয়া শব্দে উড়নছু খেলা শুরু করল কবিতায়। এ কাজে সাফল্যের জন্য সে বস্তুবিশ্ব তথা কল্পনা জগত থেকে মানানসই বাচনশব্দ তুলে এনে পাঠবস্তুর ভিজিবিলিটি বাড়াল। জীর্ণ শব্দ, জাদুকরী শব্দ, অচ্ছুৎ শব্দ ঢুকে পড়ল দীপঙ্করের কবিতায়। শুধু বাচনভঙ্গী নয়, বানানও পাল্টে দিল। যেমন - রবি--> রভি, ব্রাহ্মণ --> ব্রাহমন, মা-বোন-->মা-ব্হ্যান, এবং বিকাউ, সলতনাৎ, সুৎরা কালো, বোলবুলাবা, কারতুৎ, সিলাবেল, হিফাজত, থোপা থোপা, পুঁছতে পুঁছতে। দীপঙ্করের ভাষার আশপাশ নানা দিক থেকে আরো অনেক ভাষা উঁকি মারে। বঙ্গভাষী বাবুমানস ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না। ভাষার খোলসবদল তাদের ব্যথা দেয়। অসত-কর্ম মনে হয়। অথচ ভাষার দোগলাপন (Hybridization) তো এখন সমস্ত বিশ্বজুড়ে। আমাদের পায়ের নিচে একাধিক পুঁজি এবং সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম। বিনিময়ের হাওয়া পরিবর্তনশীল। একটি পরিবারের চারজন সদস্য মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার প্রদেশের অধিবাসী। কারণ একজন ভ্রমণবিলাসী, একজন রিফিউজি, একজন অভিবাসনকামী, একজন রাজনৈতিক কারণে স্বভূমি থেকে নির্বাসিত। তাদের ঘিরে বিশ্ববাজার, বৈদ্যুতিন মিডিয়া, সংবাদপত্র, আন্তর্জাল। তাদের ঘিরে প্রতিমুহুর্তে বিভিন্নরকম অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণবাদের নতুন নতুন খেলা। ফলে, ছিৎরানো ভাব এসেই যাচ্ছে। এবং আইডেনটিটি ক্রাইসিস। ইতিহাস সাক্ষী, বদলাচ্ছে লেখ্যভাষা তথা কথ্যভাষা। ভাষা প্রযুক্তির কাঠামো বদলের এই নকশাটা দীপঙ্করের কলমে নিপুন ভাবে ফুটে ওঠে, যা সনাতন বাংলা ভাষাকে কাঁপিয়ে দেয়। এতে ভাষার আধিপত্য বাড়ছে অবশ্যই। নোনা-ধরা পাঁচিলগুলো এক-এক করে ধসে পড়ছে। বাংলা সাহিত্য নিজস্ব বোধবিন্যাসে আরো বাস্তবসম্মত হয়ে উঠছে। কর্তাব্যক্তিরা সীমানা ভেঙ্গে দিক বা না-দিক, একদিন এই দোসুতি ভাষাই সীমানা ভেঙ্গে দেবে। সাহিত্যিক শাসকদের বানানো অনুশাসনে বিভাজন থাকবে না। এবার দেখা যাক বহু জটিলতার মধ্যে কিভাবে বুদ্ধিবল দাগায়িত করেছে অধুনান্তিক কবি - তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ যার ভাষাকাঠামোয়, বাক্যসংগঠনে, শব্দে, শব্দার্থে জঁরের চৌহদ্দি ভেঙ্গেছে এবং ব্যাপক সঙ্করায়নের ছাপ তার নাম - 'আগ্নেয় বসন্তের জাগলার', দ্বিতীয় গ্রন্থ 'কাউন্টার ব্লো', তৃতীয় গ্রন্থ - 'ব্রেক টু গেন অ্যাকসেস', চতুর্থ এবং সর্বাধুনিক গ্রন্থ - 'দীপঙ্কর দত্ত'র কবিতা'।
আগেই বলেছি, কবি বিশ্বাস করেন, কালখণ্ডের সাহিত্য সর্বজনীন। লেখার মধ্যে মরণপন প্রয়াস থাকবে, এবং বয়ানে নিরন্তর নতুনের উদযাপন। প্রান্তিকতাও একটি অনিবার্য সাংস্কৃতিক প্রতর্ক। দ্রোহ থাকবেই। অবক্ষয়, শূন্যতা, গ্লানি, হতাশার বিরুদ্ধে দ্রোহ। কবি পুঁজিবাদকে সবচেয়ে বহুবাচনিক পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আধুনিকোত্তরবাদ, তার মতে, এখন, এই সময়, পরিবর্তনের সন্ধিস্থল। দৌড়পুট দীপঙ্করকে বিশেষবৃত্তে আটকে রাখা যাচ্ছে না। সবদিকে ত্রুটি, মিথ্যাচার, দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতা। এইসবের মধ্যেই কবিতার মারাত্মক অর্থ খুঁজে বেড়ায় সে। চিন্তাচেতনায় লক্ষ লক্ষ স্ফুলিঙ্গ। তৈরী হয় আঙ্গিক ভেঙ্গে আঙ্গিকবিহীন আঙ্গিক সৃষ্টি। ''সরে দাঁড়া প্রায় দুশ ফুট এই উচ্চতা/ চুম্বকীয় আবেশ শেষ হয়ে গেলে/ পিস্টন আচমকা নেমে এসে থেঁতলে দিতে পারে/ হেই ওখানে ওখানে/ কলকব্জা লক্কর সব ওখানে ডাঁই হোক আর প্যাকিং বাক্সগুলো এদিকে'' (পোতাশ্রয়)। দীপঙ্কর নিজেই নিজের কর্তা। সর্বশেষ ভাঙ্গাগড়ার মালিক। একজন সৌখিন কৌশলী খেলোয়াড়। তার মতিগতি জীবনধারা ধরাবাঁধা গতিতে চলে না। হাত তোলার মাত্রা ভিন্ন। দৃষ্টি ভিন্ন। মগজে পাগলামির ধরণটিও ভিন্ন। তাই তার চেতনার আয়নাটিও ভিন্ন। ভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে শব্দের সঙ্গে খেলা। বিরোধিতা নয়, শুধু শব্দের কারেন্সি গোনা নয়, কবিতার শিরোনাম নির্বাচনেও দীপঙ্কর নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। যাতে অসাধারণ মজা আছে, থ্রিল আছে, ফরাৎনীল জাদুখেলা আছে। আরো আছে রুচি-পছন্দের খেরুয়া রসসম্পর্ক। যেমন, 'মিড সামার নাইটস হাউল', 'ব্রজঘাট', 'থান', 'দি ভার্টিক্যাল রেজ অব সান', 'দি সান অলসো রাইজেস', 'কোটাল', 'শাগির্দ', 'কর্ড', 'তছনছ ভীষণ কেয়সে', 'কাউন্টার ব্লো', 'আগ্নেয় বসন্তের জাগলার'। যখন নতুন কিছু সমাজ-সংসারে ঢুকে পড়ে, তখন খানিকটা বিবাদ, খানিকটা আদেখলাপনা থাকেই। দীপঙ্করের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে, বিবাদ যারা তুলছেন, তারা হাইব্রিডাইজেশন, নম্যাডিকতা, সাবঅল্টার্ন টেক্চুয়াল কি তা জানেন না। কবিতাকে একটি বিশেষ কাঠামোয় তুলে ধরা, চিত্রায়িত করা এবং আমিত্বের ঝোলাঝুলি নিয়ে কালজয়ী হওয়ার বাসনা নেই দীপঙ্করের, কিন্তু আমিত্ব-মনন-সচেতন, স্বজনপ্রিয়। অভিজ্ঞতায় অকৃত্রিম বৈভিন্ন আছে এইরকম কিছু কবি বন্ধুদের নিয়ে সে একটি জমজমা বসালো রাজধানীর দিল্লি হাটে। কে বলতে পারে, ঠিক এই জায়গাতেই মির্জা গালিব তাঁর ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে কবিতার আসর বসাতেন কি না। দিল্লি হাটের সংলগ্ন সফদরজং-চক্রউড়ালপুল। তার উত্তর দিক থেকে হাত দোলাতে দোলাতে মাথা দোলাতে দোলাতে আসে দিলীপ ফৌজদার, গৌতম দাশগুপ্ত, দেবব্রত সরকার। দক্ষিণের ব্রিজ পেরিয়ে আসে প্রাণজি বসাক, অরূপ চৌধুরী, কৃষ্ণা মিশ্রভট্টাচার্য। লম্বা আলখাল্লার মতো সফেদ কুর্তা পরে আসে সঞ্জীবন রায় টানেলের পথ ধরে। তখন দিল্লি হাটের পাথরের বেঞ্চগুলি তপ্ত খোলার মতো। দীপঙ্কর তারই ওপর পা তুলে বসে। নির্বিকার। বাওয়ালি মেজাজে নতুন ভাষায় কবিতা পাঠ শুরু হয়ে যায়। যুক্তিবিরোধী, প্রথাবিরোধী, তত্ত্ববিরোধী ''পাওয়ার পোয়েট্রি''। যা একান্তভাবেই দীপঙ্করের বাকবদ্ধ জীবনপাঠ। ভিত-কাঁপানো পৃষ্টধ্বনির তহবিল।
দিল্লির কবিদের দিশাবোধ থাক বা না থাক, বিলাসী দুঃখ তথা উদাসপারা আত্মজৈবনিক তারস আছে। গাণিতিক পণ্ডিতি-কালকেন্দ্রিকতা আছে। রীতির বিপরীত রীতি মুখজ্জাত ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে দীপঙ্কর এলো বায়ুপিত্ত কাঁপিয়ে। অতিকথন মিথ্যাকথন লঘুকথনের ক্যাননগুলি ভাঙতে শুরু করলো। এই যে সর্ববর্ণে বাঁকবদল, হৃদয়তাড়িত সর্বত্র অচ্ছুৎ আধমরা জৌলুসহীন খেরুয়া অকুলিন অবৈধ শব্দের তল্লাসী, ডিস্ট্রাকচারালাইজেশন, তা কি দীপঙ্করের রীতির বিপরীত প্রয়োগ রীতির জন্যই ?
(কবিতা ক্যাম্পাস, কলকাতা বইমেলা, ২০১১)